লিনাক্স (Linux) হলো একটি ওপেন-সোর্স অপারেটিং সিস্টেম কার্নেল। “Linux” নামটি এসেছে এর স্রষ্টা Linus Torvalds এর নাম থেকে এবং জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম Unix থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। তাই নাম রাখা হয় Linus + Unix = Linux।
লিনাক্সের সূচনা হয় ১৯৯১ সালে। একজন ফিনিশ কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, তখন Linus Torvalds ফিনল্যান্ডে পড়াশোনা করছিলেন এবং বিদ্যমান অপারেটিং সিস্টেমগুলো যেমন Unix বা Minix ছিল ব্যয়বহুল, সীমাবদ্ধ ও ওপেন সোর্স নয়। তিনি এমন একটি সিস্টেম তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা হবে—
বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য
ওপেন-সোর্স (যে কেউ পরিবর্তন ও উন্নয়ন করতে পারবে)
সবাইয়ের জন্য উন্মুক্ত
ফলাফল হিসেবে তৈরি হয় Linux kernel, যা পরে বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউশনের (Ubuntu, Fedora, Debian, RedHat, Arch ইত্যাদি) মাধ্যমে আজ বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেমে পরিণত হয়েছে।
লিনাস বেনেডিক্ট টরভাল্ডস ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ ছিল প্রযুক্তি এবং কম্পিউটারের প্রতি। পরবর্তীতে তিনি হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা শুরু করেন। সেই সময় কম্পিউটার চালানোর জন্য জনপ্রিয় সিস্টেম ছিল ইউনিক্স। কিন্তু ইউনিক্স ছিল ব্যয়বহুল এবং এর সোর্স কোড সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি ছোট সংস্করণ মিনিক্স ব্যবহার করতেন লিনাস। কিন্তু মিনিক্সের সীমাবদ্ধতা দেখে তিনি হতাশ হয়ে যান এবং নিজের একটি নতুন সিস্টেম তৈরির পরিকল্পনা করেন।
১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে লিনাস নিজের কম্পিউটারে একটি নতুন কার্নেল লেখা শুরু করেন। এটি ছিল কেবল তার শখের প্রজেক্ট। কয়েক মাস পর আগস্টে তিনি ইন্টারনেটে ঘোষণা দেন যে তিনি একটি ফ্রি অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করছেন। তখন তিনি ধারণাও করতে পারেননি যে এই ঘোষণা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি দুনিয়াকে পাল্টে দেবে।
লিনাক্সের লোগো হিসেবে পেঙ্গুইন বেছে নেওয়া হয়। এর পেছনে একটি মজার গল্প রয়েছে। লিনাস একবার একটি চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলেন এবং সেখানে একটি ছোট পেঙ্গুইন তাকে কামড় দেয়। পরে তিনি মজা করে বলেন, লিনাক্সের প্রতীক হবে পেঙ্গুইন। পরে সবাই একমত হয় যে পেঙ্গুইন শান্তিপ্রিয়, বন্ধুসুলভ এবং ওপেন সোর্স কমিউনিটির প্রতীক হিসেবে একদম মানানসই। সেই থেকেই পেঙ্গুইন Tux লিনাক্সের প্রতীক হয়ে ওঠে।
১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে লিনাস প্রথম ব্যবহারযোগ্য সংস্করণ প্রকাশ করেন। এরপর অক্টোবরে প্রকাশিত হয় লিনাক্স 0.02, যেখানে শুধু bash এবং gcc চালানো যেত। এর পর থেকে সারা বিশ্বের প্রোগ্রামাররা এই প্রজেক্টে যুক্ত হতে শুরু করেন এবং লিনাক্স দ্রুত উন্নত হতে থাকে।
১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় লিনাক্স 1.0, যা ছিল প্রথম স্টেবল ভার্সন। এতে ছিল প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার লাইন কোড। এটি কেবল একটি অপারেটিং সিস্টেম নয়, বরং একটি ওপেন সোর্স আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ লিনাক্স ছিল ফ্রি, ওপেন সোর্স এবং পরিবর্তনযোগ্য।
আজ লিনাক্স কেবল একটি কার্নেল নয়, বরং একটি বিশাল ইকোসিস্টেম। সার্ভার, সুপারকম্পিউটার, ক্লাউড সিস্টেম এমনকি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলও লিনাক্স কার্নেলের উপর নির্ভর করে। যা একসময় ছিল এক শিক্ষার্থীর শখ, সেটাই আজ কোটি কোটি মানুষের জীবনের অংশ। আর সেই ছোট্ট পেঙ্গুইন Tux এখনো মনে করিয়ে দেয় যে প্রযুক্তি কেবল কোম্পানির জন্য নয়, বরং সবার জন্য।
লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশন (ডিস্ট্রো) হলো লিনাক্স কার্নেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি একটি পূর্ণাঙ্গ অপারেটিং সিস্টেম। শুধু কার্নেল থাকলে আপনি কম্পিউটার চালাতে পারবেন না, তাই ডিস্ট্রোর মধ্যে থাকে—
লিনাক্স কার্নেল
বিভিন্ন সফটওয়্যার প্যাকেজ (যেমন কম্পাইলার, এডিটর, ব্রাউজার)
গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস (যেমন GNOME, KDE)
প্যাকেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (যেমন apt, yum, pacman)
ডিস্ট্রো essentially হলো লিনাক্সকে ব্যবহারযোগ্য বানানোর প্যাকেজ।
ডিস্ট্রো তৈরির জন্য সাধারণভাবে যা লাগে—
লিনাক্স কার্নেল – যেটা সিস্টেমের মূল।
সফটওয়্যার প্যাকেজগুলো নির্বাচন – কোন কম্পাইলার, এডিটর, ব্রাউজার, ইউটিলিটি থাকবে তা ঠিক করতে হয়।
গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস (GUI) – চাইলে GUI দেওয়া হয়, না দিলে CLI (Command Line Interface) থাকে।
প্যাকেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম – apt, yum, pacman বা zypper ইত্যাদি।
ডকুমেন্টেশন ও লাইসেন্স – ওপেন সোর্স লাইসেন্স অনুযায়ী কোড শেয়ার করা হয়।
শর্তগুলো:
কোড অবশ্যই লিনাক্স কার্নেল বা ওপেন সোর্স লাইসেন্স অনুযায়ী হতে হবে।
যেকোনো থার্ড-পার্টি সফটওয়্যার যুক্ত করতে হলে তার লাইসেন্স চেক করতে হবে।
কার্নেল ও প্যাকেজগুলোর ভার্সন ঠিকভাবে কম্প্যাটিবল থাকতে হবে।
বেশিরভাগ লিনাক্স ডিস্ট্রো ফ্রি ও ওপেন সোর্স, কিন্তু কিছু ডিস্ট্রো প্রিমিয়াম বা এন্টারপ্রাইজ ভার্সন দেয়, যেখানে থাকে—
অফিসিয়াল সাপোর্ট ও আপডেট
নিরাপত্তা প্যাচ
কর্পোরেট বা সার্ভার ব্যবহারের জন্য বিশেষ টুলস
উদাহরণ: Red Hat Enterprise Linux (RHEL), SUSE Linux Enterprise
হ্যাঁ, একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সম্পূর্ণভাবে লিনাক্সে তার ডেভেলপমেন্ট লাইফ কাটাতে পারে। লিনাক্সে আপনি করতে পারেন—
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট – C, C++, Python, Java, Rust, Go, PHP ইত্যাদি ভাষা।
ওয়েব ডেভেলপমেন্ট – Apache/Nginx সার্ভার, MySQL/PostgreSQL ডাটাবেস, Node.js, Laravel, Django ইত্যাদি।
অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট – Android অ্যাপ (Android Studio + Linux), Flutter, React Native।
ডাটাবেস ম্যানেজমেন্ট ও সার্ভার কনফিগারেশন – Linux server, Docker, Kubernetes, Cloud deployment।
সিকিউরিটি ও পেন্টেস্টিং – Kali Linux বা Parrot OS ব্যবহার করে।
স্ক্রিপ্টিং ও অটোমেশন – Bash, Python, Perl।
কারণ লিনাক্স ডেভেলপার-ফ্রেন্ডলি, সহজে কমান্ড লাইন ব্যবহার করা যায়, সার্ভার ও ডেভেলপমেন্ট টুলস সরাসরি পাওয়া যায়, এবং পুরো সিস্টেম ওপেন সোর্স।
সুতরাং, একজন ইঞ্জিনিয়ার চাইলে পুরো দিন লিনাক্সে কাজ করে সফটওয়্যার, অ্যাপ, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং সার্ভার ম্যানেজমেন্ট করতে পারে। অনেক প্রফেশনাল ডেভেলপার এবং কোম্পানি পুরোপুরি Linux environment-এর উপর ভিত্তি করে ডেভেলপমেন্ট করে।